নাটক- শান্তির বার্তা

শান্তির বার্তা
– রাখী চক্রবর্তী

 

 

চরিত্রায়ণে– যোগীরাজ,
ডিমপি ও তার মা বাবা এবং
আম্রপালী

আবহ সংগীত

আম্রপালী: সকাল থেকে হরিদ্বারের পথে পথে ঘুরছি “প্রেম নগর” আশ্রম তো চোখে পড়লো না, নতুন বাবু তো বলেছিলেন এই আশ্রমে থাকার ব্যাবস্থা আছে, আর একটু এগিয়ে যাই, তেষ্টাতে গলা ফেটে যাচ্ছে..যে ভাবে বেরিয়ে এসেছি ওদের কবল থেকে, এখনও ভাবলে গায়ে কাটা দিচ্ছে। ঐ তো, বড় বড় অক্ষরে লেখা “প্রেম নগর আশ্রম”।
যাই ভেতরে যাই, বাহ্ মন জুড়িয়ে গেল। যোগীবাবার এত মধুর কণ্ঠ স্বর

যোগীরাজ: হরি ওমঃ হরি ওমঃ গোবিন্দা, শান্তি, শান্তি ,শান্তি
শান্তি পাবে সবখানে
মনটা যদি পবিত্র রাখো
ভক্তি শ্রদ্ধা যদি করো গুরুজনে
লোভ, হিংসা, লালসা
বাদ দিয়ে স্মরণ করো পরমেশ্বরকে
তবেই শান্তি পাবে।

আম্রপালী: বাবা আমার মন অশান্ত থাকে সবসময়। পারিনা অতীতকে ভুলতে। তোমার চরণে ঠাঁই দাও বাবা।

যোগীরাজ: আমার না, ভগবানের চরণে ঠাঁই নে। সব ব্যথা ভুলে যাবি। ঐ যে গঙ্গার ঘাট দেখছিস। কতো মানুষ দেখতে পারছিস,
ওরা শান্তির খোঁজে এসেছে এখানে, গঙ্গায় ডুব দিয়ে দেহ মন শুদ্ধ করছে, যা একবার যা.. গঙ্গায় ডুব দিয়ে আয়। দেখ, মনটা কি বলে তোর, যা যা।

আম্রপালী: গঙ্গায় ডুব দিলেই কি মনে শান্তি ফিরে আসবে বাবা। ওরা সবাই শান্তি পাবে কি? যারা এখন গঙ্গায় ডুব দিচ্ছে।

যোগীরাজ: আমার আশ্রমে যারা প্রথম আসে তাদের সবাইকে গঙ্গায় ডুব দিয়ে আসতে বলি, শুধু তুই না মা।

আম্রপালী: বাবা তোমার আশ্রয়ে যারা আসে তারা সবাই নাকি শান্তি পায়। তবে আমি কেন কষ্ট পাই। নাচে গানে প্রতিটা সন্ধ্যা, রাত আমি মাতিয়ে রাখি ওদের।আম্রপালীর কোঠায় যখন খদ্দেররা টাকার বৃষ্টি ওড়ায় আমার মন তখন চঞ্চল হয়ে ওঠে। টাকার নেশায় তো আমি নাচনেবালী হইনি। আমি তো লেখা পড়া শিখে সমাজে মাথা উঁচু করে মা বাপিকে নিয়ে বেঁচে থাকতে চেয়েছি। তোমার ভগবান সেটাও মঞ্জুর করলো না বাবা।

যোগীরাজ: অনেক কিছু হারিয়েছিস তাই না মা..

আম্রপালী: বাপিকে হারিয়েছি, স্বপ্নগুলো হারিয়েছি। বাপির সাথে সাথে সুখ শান্তিকেও হারিয়েছি। অর্থ অনেক উপার্জন করলাম।আলমারি ভর্তি টাকা গয়না, কিন্তু মনটা খালি আছে বাবা। আজ আমি অর্থ-ঐশ্বর্য সব ছেড়ে তোমার আশ্রয়ে এসেছি। নতুন জীবন শুরু করবো বাবা।

যোগীরাজ: তবে যা গঙ্গায় ডুব দিয়ে আয়।

আম্রপালী: না, না বাবা কিছুতেই আমি গঙ্গায় ডুব দিতে পারবো না। দম বন্ধ হয়ে আসবে আমার। সেবার বাপির সাথে গঙ্গায় স্নান করতে গেছিলাম। বাপি আর ফেরেনি আমার সাথে। আমি বাপির হাত ধরে এক ডুব দিলাম, দুই ডুব দিলাম তারপর তিন ডুব দেওয়ার সময় বাপি আমার হাত ছেড়ে দিল দম বন্ধ হয়ে আসছিল আমার। জল থেকে মাথা তুলে দেখি বাপি নেই। কতো খুঁজলাম.. কোথাও পেলাম না বাপিকে! তারপর পনেরো বছর কেটে গেল। খুঁজে চলেছি আজও বাপিকে।

যোগীরাজ: তোর মার কথা কিছু বললি না তো?

আম্রপালী: আমার মার জীবন যাত্রা অন্য রকম ছিল। পার্টি করে অনেক রাত করে বাড়ি ফিরতো মা। বাপি আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিত। ঘুমের ভান করে আমি চোখ বুঝে বিছানায় শুয়ে থাকতাম। মা নেশা করে খুব গালিগালাজ করতো বাপিকে। সারা রাত বাপি সোফায় বসে থাকত। তারপর আমি ঘুমিয়ে পড়তাম। ভোর বেলায় চোখ খুলে দেখি বাপি সোফায় ঘুমিয়ে আছে। টাকাপয়সা সম্পত্তি বাড়ি গাড়ি সব ছিল আমাদের। শুধু শান্তি ছিল না।
একদিন মা বাপিকে বললো, ডিমপিকে নিয়ে গঙ্গায় স্নান করে এসো তারপর কালীঘাটের মন্দিরে যাবো আমরা সবাই।
বাপি বললো তুমিও চলো। একসঙ্গে স্নান করবো গঙ্গায়।
মা বললো, আমার খুব ভয় লাগে গঙ্গায় স্নান করতে। তোমরা যাও।
আমার তখন চোদ্দ বছর বয়স। খুব আনন্দ হয়েছিল সেদিন আমার আর বাপির।
সকাল দশটার সময় গঙ্গার ঘাটে গেলাম আমি আর বাপি। খুব বেশি লোকজন ছিল না গঙ্গার ঘাটে। বাপি আমার হাত শক্ত করে ধরে গঙ্গার জলে নামালো। আমি সেদিন প্রথম গঙ্গার জলে নামলাম। খুব ভয় করছিল আবার আনন্দও হচ্ছিল, মা ভালো হয়ে গেছে এই ভেবে। কতো স্বপ্ন দেখছিলাম সেই মুহূর্তে। আমি, বাপি আর মার হাত ধরে ঘুরছি, আনন্দ করছি। কত্তো ভালোলাগা আমার চারপাশে। আমি দু’চোখ ভরে দেখছি। জল উচলাচ্ছি দু’হাতে। এমন সময় বাপি বললো, চল মা এবার ডুবকি লাগাই। আমি বললাম, না বাপি আমার খুব ভয় করছে। বাপি বললো, আরে মা আমি আছি তো। ভয় কি মা..তখন মনে হল তাই তো বাপি আছে ভয় কিসের।
প্রথম ডুব, দ্বিতীয় ডুব দিলাম তারপর ডুব দিতেই বাপি আমার হাত ছেড়ে দিল। দম বন্ধ হয়ে গেছিল আমার। বাপি বাপি করে কত্তো ডাকলাম। বাপি ফিরলো না।
অনেক খোঁজ চললো গঙ্গার জলে। বাপির দেহ পুলিশ পেল না। মা বললো বাপি নাকি গঙ্গার জলে তলিয়ে গেছে। আমি একা হয়ে গেলাম, খুব একা!
এই ঘটনার এক মাসের মধ্যে মা আরো পাল্টে গেল। নানান রকম লোকজন জমায়েত হতে লাগল আমাদের বাড়িতে।তিন মাস এভাবেই চললো। তারপর এক রাতে আমি ঘুম থেকে উঠে দেখলাম অজানা অচেনা বিছানায় শুয়ে আছি এক পুরুষের সাথে। আমি অবাক হয়ে গেলাম, কি করে সম্ভব হল এটা! আমি তো মার কাছে শুয়ে ছিলাম। কিছুক্ষণ পরে জানতে পারলাম মা নাকি বিক্রি করে দিয়েছে আমাকে। যেই বাড়িতে ছিলাম ওরাই বলছিলো। ডিমপি থেকে আম্রপালী হলাম। পড়ুয়া থেকে নাচনেবালী হলাম। মা থাকতে অনাথ হলাম।টাকা পয়সা সম্পত্তি হল তবে শান্তি পেলাম না। অনেক কষ্টে আম্রপালী কোঠা থেকে বেরিয়ে এসেছি। আর ফিরবো না ওখানে।তোমার আশ্রয়ে থাকবো। থাকতে দেবে তো বাবা?

যোগীরাজ: আমি আজ খুব খুশি মা তোকে পেয়ে..চল মা আমার সাথে আশ্রমটা ঘুরে দেখবি।

আম্রপালী: বাবা ঐ মহিলা কে? মাটির পুতুল গড়ছে আর ভাঙছে।

যোগীরাজ: দেখতো মা ভালো করে। চিনতে পারছিস কি?

আম্রপালী: খুব চেনা চেনা লাগছে। মাথা ভর্তি লাল চুল। কিন্তু মুখটা লালচে হয়ে গেছে। চোখ দু’টো তো খুব চেনা। ঠিক আমার মায়ের মতো। টানা টানা চোখ। না..না মা কি করে হবে। মা তো টাকার পাহাড়ে বসে আছে। সে কেন এই আশ্রমে আসবে!

যোগীরাজ: ঝড় বৃষ্টির একরাতে আমার শিষ্যরা ওনাকে নিয়ে আসে, রাস্তায় বসে কাতরা ছিলেন উনি, আমি দেখেই চিনতে পেরেছিলাম তোর মাকে।

আম্রপালী: আমার মা! তুমি কে বাবা?

যোগীরাজ: জানিস মা, আমার হারিয়ে যাওয়া মেয়ের খোঁজ পেতে আমি এই আশ্রমে আগত সব মায়েদের মেয়েদের বলি গঙ্গায় ডুব দিয়ে এসো আগে।
আমার মেয়ে হলে ঠিক ভয় পাবে জলে নামতে। আজ আমি পরম শান্তি পেলাম ডিমপি মা আমার..

আম্রপালী: বাপি,তুমি আমার বাপি! কিন্তু তোমার একি অবস্থা হয়েছে! কি হয়েছিল বাপি সেদিন?

যোগীরাজ: তিনবার ডুব দিয়ে যখন উঠতে যাব ঠিক তখনি তোর মার পাঠানো ছেলেটা আমার গলা টিপে ডুব সাঁতার দিয়ে আমাকে নিয়ে গেল। তারপর যখন আমার জ্ঞান ফিরলো দেখি এক পরিত্যক্ত গঙ্গার ঘাটে আমি পড়ে আছি। মাটিতে সারা শরীর ভর্তি।সারা রাত ঐ ভাবেই পড়ে ছিলাম ।ভোর বেলায় এক সন্ন্যাসী আমাকে এই অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে ওনার লোকেরা আমাকে এখানে নিয়ে আসেন। দৃষ্টি শক্তি আমার লোপ পেয়েছিল। চোখের ডাক্তার বললেন বাম চোখ ক্ষতি হয়েছে। বাম চোখ নষ্ট হয়ে গেছে আমার। কালো চশমা পড়ে থাকি দিনের বেলায়। চশমা খুললাম। দেখতো মা চিনতে পারিস কিনা?

আম্রপালী: হ্যাঁ, তুমি আমার বাপি। এই তো আমার বাপি, কিন্তু ওই মহিলা কি আমার মা? মাকে কি ওরা ঠকিয়ে ছিল, মার সব কিছু নিয়ে মাকে বাড়ি থেকে পথে বের করে দিয়ে ছিল ওরা?

যোগীরাজ: সে সব জানি না মা, তবে দশ বছর ধরে তোর মা এখানে আছে। আমাকে চিনতে পারে না। বোধ শক্তি লোপ পেয়েছে।কুকর্ম ফলের ফল ভোগ করছে তোর মা।আমি তোর জন্য উতলা হয়ে ছিলাম মা। কত চেষ্টা করেছি আমাদের বাড়িতে লোক পাঠিয়ে তোর খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য।কিন্তু পাই নি মা তোর কোনও খবর। কত্তো বড় হয়ে গেছিস মা। আমিও তোকে চিনতে পারিনি।

আম্রপালী: বাপি আজ আমি খুব খুশি, তোমাকে পেলাম, শান্তি পেল আমার মন।

যোগীরাজ: আমি আর তুই আজ থেকে শান্তির বার্তা নিয়ে হরিদ্বারের পথে পথে ঘুরবো, মানুষের মনে শান্তির বার্তা পৌঁছাবো।

আম্রপালী: মাকে সুস্থ করতে হবে বাপি, মার স্মৃতি শক্তি ফেরাতে হবে।

যোগীরাজ: হরি ওম, হরি ওম, গোবিন্দা,
শান্তি, শান্তি, শান্তি

Loading

Leave A Comment